রাশেদ খান মেনন কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংকট প্রসঙ্গে বলেছেন, “বিজেপি তার নীতির ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন করার ব্যবস্থা করে ফেলছে।”
আমি একেবারে নিশ্চিত না হলেও প্রথম আলোতে প্রকাশিত পুরো সংবাদের টোনে ধরে নিচ্ছি, মেনন এখানে সংখ্যালঘু বলতে বাংলাদেশের হিন্দুদের বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ বলতে চেয়েছেন বিজেপি হিন্দুত্ত্ব নীতি নিয়ে বাংলাদেশে অগ্রসর হয়েছে এবং বাংলাদেশের হিন্দুদের সমস্যা বিজেপির হিন্দুত্ত্ব চোখ দিয়ে বিচার করে দেখতে হিন্দুদের উদ্বুদ্ধ করেছে। মানে বাংলাদেশে বিজেপির প্রত্যক্ষ রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। আর এই রাজনীতি বাংলাদেশের হিন্দুদের “জীবন বিপন্ন করার ব্যবস্থা করে ফেলেছে”। মেনন বলছেন সংখ্যালঘুর মনে বিপন্নতা সৃষ্টি করাটা বিজেপির একটা নীতি। তাহলে বিজেপির এই নীতিটা দিয়ে কী অর্জিত হবে? আর এই নীতি কার্যকর হচ্ছেই বা কীভাবে? মেনন এটা বলেননি। এই প্রশ্নের সাম্ভব্য উত্তর হচ্ছে; বিজেপির পরবর্তি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য বাংলাদেশের হিন্দু ইস্যুকে কাজে লাগাবে। বাংলাদেশে একটা সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হলে সেটার পুরো বেনিফিট নেবে বিজেপি। বলির পাঁঠা হবে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়।
মেননের সমস্য হল এই সরকারের মন্ত্রিত্ব তার চাইই। আবার সরকারী রাজনীতির (রাজনীতি মানে ভারতের গায়ে ঢলে পড়া, এবং সে অর্থে ক্ষমতায় বিজেপি আছে বলে এই রাজনীতির সাথে সখ্য ও এই রাজনীতির সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি) সবই মেনন সহ্য করে মেনে নিতে বাধ্য। কিন্তু তিনি একই সাথে কলকাতা সিপিএমের মোদি বিরোধি অবস্থানওটা সরকারের মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও চর্চা করতে চাইছেন। এই হল তার জটিলতা – শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা।
এটা বুঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিজেপির অনুপ্রবেশের বিষয়টা সরকারকে ভাবাচ্ছে। তাই মুনতাসির মামুন হিন্দু সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে লেখেন। এটাই সরকারের বার্তা। আরেকটি বিষয় কি আপনাদের চোখে পড়েছে? সেটা হচ্ছে সরকার যা বলছে সেটা হিন্দু সম্প্রদায় বিনা বাক্যে মেনে নিচ্ছেনা জন্যই সরকারকে ‘বুদ্ধিজীবীদের’ দিয়ে বার্তা দিতে হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত ফেনোমেনন। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন অংশ যদি অসচেতনভাবে বিজেপির পলিটিক্যাল উদ্দেশ্যের ক্রীড়নক হয়ে ওঠেন সেটা ভয়ানক বিপদজনক। হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণদের সকল আবেগ ক্ষোভ বিক্ষোভকে পাশে ফেলে দূরদৃষ্টি দিয়ে এই ক্রান্তিকালের পথ খুঁজে নিতে হবে। এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। আপনাদের পাশে সবাই দাঁড়াবে কিন্তু প্লিজ বিজেপি, ছদ্ম প্রগতিশীল আর নাস্তিকদের প্ররোচনায় পা দেবেন না।
কঠিন সত্যি হল, বাংলাদেশের হিন্দুদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে কলকাতা বিজেপির রাজনীতির খপ্পড়ে পড়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাথে হিন্দুদের যে সম্পর্কের খটমট যা দেখা যাচ্ছে তা এরই প্রতিফলন। এটা বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য ভয়ানক পথ। সারা ভারতের হিন্দুরা হয়তো থিওরিটিক্যালি বিজেপি-আরএসএস এর হাত ধরে মুসলমানদের সাথে সরাসরি সংঘাতে যেতে পারে। তারা এই রাজনীতিতে পরিচালিত হতে হয়ত পারে। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য এটা প্রযোজ্য হবে কী? এমনিতেই বিজেপির রাজনীতি সংকীর্ণ, বিভেদকামী, উগ্র রেসিজমের; ফলে এটা আদৌ বাংলাদেশের হিন্দুরা গ্রহণ করতে পারে কী? এছাড়া বাংলাদেশে হিন্দুদের সমস্যার সমাধান প্রতিশোধ বা প্রতিহংসার বিষয় নয়; এটা দুরদর্শী রাজনৈতিক ফয়সালার বিষয়, যা দাড়িয়ে থাকবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বোঝাপড়ার উপরে।
এই বাস্তবতা যত দ্রুত আমরা সবাই বুঝতে পারবো তত দ্রুত সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে। আমার ধারণা বাংলাদেশের মুসলমানেরা হাত বাড়িয়ে আছেন, আপনারা শুধু বিজেপির বাড়িয়ে দেয়া হাত ছেড়ে আপনার আশৈশব পড়শির হাত ধরুন। আর তার হাতে হাত রেখেই এই অমানিশা একসাথে পেরিয়ে যাওয়ার শক্তি পেয়ে যাবেন।