মহারাষ্ট্রে ‘গরু’ হত্যা বন্ধ হলো কিন্তু বাঙলার ‘গো-ধন’ রক্ষা করবে কে?

মহারাষ্ট্রে গো হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে ধর্মের কারণে। আমি কিছুদিন আগে গভীর মনোযোগ দিয়ে ঋগ্বেদ পাঠ করেছি। বেদসমুহ সনাতন বৈদিক ধর্মের মুল গ্রন্থ। সব ধর্ম গ্রন্থেই অসংখ্য মেটাফর থাকে রূপক থাকে, সেটার মর্মার্থ বুঝতে হলে মেটাফরের আচ্ছাদন খুলে ধর্মগ্রন্থের মুল বাণী পাঠ করতে হয়। ঋগ্বেদ লেখা হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার শেষ দিকে। তাই সিন্ধু সভ্যতার সাথে সাথে মিলিয়ে ঋগ্বেদ পাঠ করা জরুরী। নইলে ঋগ্বেদের পাঠোদ্ধার অসম্ভব।

সিন্ধু সভ্যতা ছিল বিশ্ব সভ্যতার সূতিকাগার। এ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার চাইতে পুরনো আর উন্নত সভ্যতা পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়নি। সিন্ধু সভ্যতা ছিল সেই সময়ের বিচারে স্যেকুলার, গণতান্ত্রিক, নগর ভিত্তিক, ফেডারেল সমাজ। সেই সাথে তুলনামুলক সাম্য এবং অবিশ্বাস্য সমৃদ্ধি ছিল সেই সভ্যতার। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানে ছিল তাঁদের তুঙ্গ স্পর্শী দক্ষতা। ভারতের মূল সাতটি নদীকে ঘিরে অসংখ্য বাধ আর ব্যারেজ দিয়ে জলপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে উষর ভুমিতে ফসলের আর সম্পদের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল তাঁরা। সেই ব্যারেজে ছিল স্লুইস গেইট।

নদী শাসনের বিরুপ প্রভাবে নদী বক্ষে পলি জমে জমে ভুমিক্ষয়, অতিবন্যা, খরা, কিছু এলাকায় পানিশূন্যতায় পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে ভারতের অধিকাংশ এলাকায়। সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বৈদিক ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতার শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়। বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল বাধ আর ব্যারেজের ধ্বংস সাধন আর বিদ্রোহের সেনাপতি ছিল ইন্দ্র। ঋগ্বেদের কবিতার ছত্রে ছত্রে রূপকের মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই বাধ আর ব্যারেজ ধংসের কাহিনী। ঋগ্বেদ সেই বিদ্রোহের ভাষাকে ধারণ করেছে। কেউ মন দিয়ে খোলা মনে ঋগ্বেদ পড়লে অবলীলায় অর্থোদ্ধার করতে পারবেন সেই বিদ্রোহের আর জল মুক্ত করার ঘটনা। ঋগ্বেদে জলপ্রবাহ বন্ধ করা আর নদী শুকিয়ে মারা মহাপাপ। জলপ্রবাহ মুক্ত করা উপাসনার তুল্য দেবতার কাজ। ঋগ্বেদে ইন্দ্র যত যুদ্ধ করেছে সবগুলোই জল প্রবাহ মুক্ত করার জন্য।

আরেকটা বিস্ময়কর বিষয় আবিষ্কার করলাম। “গো” শব্দের আরেকটা অর্থ সংস্কৃতে “জল” বা “পানি”। ইন্দ্র অনেক জায়গায় আটকে রাখা “গো” ধন মুক্ত করেছেন। “গো হত্যা” মহাপাপ এই বাক্যের আরেকটা অর্থ হতেই পারে “নদী হত্যা মহাপাপ”। আজও নদী মাতৃক দেশ হওয়ায় আমরা নদীকে মাতৃ জ্ঞানে ভক্তি করি; আমরা বলি নদী আমাদের “মা”। গোমাতা শব্দের উৎপত্তি নদীকে “মা” বলে ডাকার সংস্কৃতি থেকে উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা অসঙ্গত নয়।
ঋগ্বেদের একটি প্রাসঙ্গিক শ্লোক দেখুন।

“হে অঙ্গিরাবংশীয় বৃহস্পতি! পর্বত গো সমুহ আবরন করেছিল। তোমার সম্পদের জন্য যখন তা উদ্ঘাটিত হল এবং তুমি গো সমুহ কে বার করে দিলে, তখন ইন্দ্রকে সহায় পেয়ে তুমি বৃত্র কর্তৃক আক্রান্ত জলের আধারভুত জলরাশিকে অধোমুখ করেছিলে।” (ঋগ্বেদ ২/২৩/১৮)
(এখানে পর্বত বাধ বা ব্যারেজের রুপক, গো জলের, ইন্দ্র বৈদিক ঋষিদের বিদ্রোহের সেনাপতি আর বৃত্র একটি বৃহৎ ব্যারেজের নাম)

এমন অসংখ্য শ্লোক আছে যেখানে ইন্দ্র হয় গো ধন মুক্ত করেছেন অথবা জলরাশি মুক্ত করেছেন।

এই অঞ্চলের ভু রাজনীতিতে পানি একটি মূল বিষয় ছিল সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে আর আজকে তো অবশ্যই। মহারাষ্ট্রে না হয় “গরু” হত্যা বন্ধ করলেন, কিন্তু বাঙলার “গো ধন” তিস্তা আর পদ্মাকে যে খুন করে ফেললেন সেটা থেকে কোন ইন্দ্র আমাদের মুক্তি দেবেন?

লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter