প্লেটোর সাথে অ্যারিস্টটলের মুল বিতর্কটা ছিল “ইউনিভার্সাল” বা বাঙলায় যাকে “সামান্য” বলে জানি সেই ধারণা নিয়ে। এই যুদ্ধের গর্জন আমাদের কাল পর্যন্ত গড়িয়ে এসেছে। মদ্ধজুগে এই বিতর্কের রেশ টেনেছেন রিয়ালিস্ট আর নরমালিস্টরা। ফ্রিড্রিশ স্লেগেল এই বিতর্ক প্রসঙ্গেই বলেছিলেন, “প্রত্যেক মানুষ হয় প্লেটোপন্থি নতুবা অ্যারিস্টটলপন্থী হয়ে জন্মেছে।“
প্লেটোর সামান্যের ধারণা কী ছিল? প্লেটো মনে করতেন আমরা যেসকল বস্তু নিচয় দেখি সে সমস্ত বস্তু নিচয় দেখে তার মর্মার্থ দেখা যায়না। যেমন আমরা যখন ফুল দেখি তখন তো “ফুল” বলে কোন ইউনিভার্সাল কিছু দেখিনা। দেখি হয় গোলাপ অথবা কাঁঠাল চাপা দেখি, ফুল তো দেখিনা। কিন্তু বলি “গোলাপ একটা ফুল”, আমরা বিশেষকে বুঝাতে নির্বিশেষ ব্যবহার করি। প্লেটো এই নির্বিশেষ কেই ইউনিভার্সাল বা সামান্য বলেছেন। প্লেটো বলেছেন “ফুলত্ব” বলে একটা জিনিস আছে। ঠিক যেমন মনুষ্যত্ব। সেই “ফুলত্ব” হচ্ছে ইউনিভার্সাল এটা এই জগতে থাকেনা, থাকে আদার ওয়ার্ল্ডে। সেখানে থেকে আত্মার মাধ্যমে এই ইউনিভারসেল কে আমরা এই ওয়ার্ল্ডে নিয়ে আসি।
অ্যারিস্টটলের কাছে ইউনিভার্সাল হল যে কোন জাতিগত বিশেষ্য বা কমন নাউন বা যে কোন নাম যা একটা শ্রেণীর সদস্যদের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু এই সারবিকগুলো আত্মগত প্রত্যয়, অব্জেক্টিভ রিয়ালিটি নয়। তারা হল নাম, বস্তু নয়। আমাদের বাইরের জগতটা স্বতন্ত্র ও নির্দিষ্ট বস্তুর, জাতিগত ও সার্বিক বস্তুর নয়। মানুষেরা আছে, গাচেরা আছে, প্রাণীরা আছে; কিন্তু চিন্তার জগত ছাড়া ইউনিভার্সাল মানুষের বা সামান্য মানুষের অস্তিত্ব নাই। সামান্যর ধারণা একটা সুবিধাজনক মানসিক নির্মাণ, যেখানে অব্জেক্টিভিটি অনুপস্থিত।
প্লেটো মনে করতেন ইউনিভার্সালের বিষয়গত অস্তিত্ব আছে। প্লেটো বলেছেন ইউনিভার্সাল হল ব্যক্তির চেয়ে তুলনাহীন ভাবে আরো দীর্ঘস্থায়ী, গুরুত্বপূর্ণ এবং সারবস্তু সম্পন্ন। ব্যক্তি নিছক সেখানে অবিরাম তরঙ্গের ভেতর ছোট একটা ঢেউ। মানুষেরা আসে এবং চলে যায়, কিন্তু “ইউনিভারসেল মানুষ” থেকে যায়।
অ্যারিস্টটল প্লেটোর এই ইউনিভার্সেলের ধারণাকে দেখেছেন অন্তহীন অতিন্দ্রিয়বাদ এবং পণ্ডিতি আহাম্মকি হিসেবে।
লালন ও এই সামান্যের ধারণা নিয়ে ভেবেছেন তর্ক করেছেন। লালনের একটা বিখ্যাত গান আছে।
“পাবে সামান্যে কি তার দেখা বেদে নাই যার রূপরেখা।
সবে বলে পরম ইষ্টি কারো না হইলো দৃষ্টি।
বরাতে করিল সৃষ্টি তাই লয়ে লেখাজোখা।।
নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে সদাই ফেরে অচিন দেশে।
দোসর তার নাইকো পাশে ফেরে সে একা একা।।
কিঞ্চিত ধ্যানে মহাদেব সে তুলনা কি আর দেবো।
লালন বলে গুরু ভাবো যাবে রে মনের ধোঁকা।।
লালন প্লেটোর ইউনিভারসেলের ধারণা গ্রহণ করেননি। তিনি অ্যারিস্টটলকেও মানেননি। তিনি বিশেষকে ধরে পরমের কাছে পৌছাতে চেয়েছেন। সেই যাত্রার সাথে ইউরোপের চিন্তার জগতের কোন মিল নেই।
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন