কবিতা নিয়ে অকবির ভাবনা

আমি প্রথমেই পাঠকের কাছে মাফ চেয়ে নেই এটা বলে যে আমি অকবি। কবিতার একজন নগণ্য পাঠক। তবে এহেন অকবির কবিতা নিয়ে বলার স্পর্ধা হতোনা যদিনা, কবিদের কাছে থেকেই কবিতা নিয়ে লেখার অনুরোধ আসত। ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে অন্তত বাংলার কবিদের কবিতা নিয়ে একজন অকবির ভাবনা জানবার সুযোগ হয়েছে। আমিও নির্ভয়ে কিছু কথা বলতে পারবো।

বাংলা কবিতা পড়তে পড়তে কখনো আবৃত্তি করতে করতে যেই আঙ্গিক বা ফর্মটার সাথে পরিচিত হয়েছি সেটা আধুনিক ইউরোপীয় ফর্ম। আধুনিক কবিতার কান তাই বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদেআমি ভালবাসি মেঘ চলিষ্ণু মেঘ শোনে তখন খটকা লাগেনা। আঙ্গিকের দিক থেকে পশ্চিমা কবিতা চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে যায় আমাদের মধ্যবিত্ত কানে। আমরা কবিতা বলতে এই ইউরোপীয় আধুনিক আঙ্গিকের লেখাই বুঝি। এই কাব্য না হয় মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ক্ষুধা মেটালো, কিন্তু গণ মানুষের কাব্য হয়ে উঠতে পারলো কি? এমনকি রবীন্দ্রনাথও কি সেই জায়গায় পৌছুতে পেরেছিলেন? আমরা নির্ধিধায় বলতে পারি, না পারেনি।

বাংলার সাধারণ মানুষের কাব্য চর্চার যে ধারা সেটা আমরা লক্ষ্য করি সেটা কাহিনী নির্ভর প্রকরণ আর ধর্মীয় উপমা ও প্রতীকের ধারায় রচিত কাব্য; যার মধ্যে থাকে বুদ্ধিদীপ্ত দার্শনিক প্রশ্ন। জারি গান বা কৃষ্ণ কীর্তনের পালাও সেইরকম কাহিনী নির্ভর। এই আঙ্গিকের সাথে বাংলা আধুনিক কবিতার উদ্ভবের সময় থেকেই বাংলা কাব্যের একটা ছেদ তৈরি হয়েছে। তাই মধ্যবিত্তের কাব্য চর্চার স্বাদ নিচ তলার মানুষ নিতে পারেনা, আবার একইভাবে নিচ তলার মানুষের কাব্যচর্চা উন্নাসিক বাঙালি মধ্যবিত্তের আগ্রহ সঞ্চার করতে পারেনা।

নিম্নবর্গের কাব্যচর্চার নমুনা হিসেবে লালন ফকিরের গান থেকে একটা উদাহরন দেই,

মেরাজ ভাবের ভুবনে

গুপ্ত ব্যক্ত আলাপ হয় দুজনে

কে পুরুষ আকার কে প্রকৃতি শাস্ত্রে তার প্রমাণ লিখেছে

সাংখ্য দর্শনের পুরুষ আর প্রকৃতির ধারণা দুর্ধর্ষ ভাবে দার্শনিক প্রজ্ঞায় লালন মিলিয়েছেন মেরাজের ঘটনার সাথে। এখানে রক্তমাংসের নবী রাসুল ইহলৌকিক পৃথিবীর ইতিহাসের শর্ত হয়ে পুরুষরূপি স্রষ্টার সাথে মিলিত হচ্ছেন কি? এই প্রশ্নই তুলেছেন লালন। সেই দার্শনিক প্রশ্নের মোকাবেলা বাংলা কাব্যের মধ্যে দিয়ে নিম্নবর্গের মানুষ করতে চেয়েছে। কাব্যের মধ্যে দিয়ে দর্শনের দিগন্ত উন্মোচনের অমিত সাহস করেছিল বাংলার নিম্নবর্গ। সেই সম্ভাবনাকে মধ্যবিত্তের চিন্তা কখনো বুঝতে চেষ্টা করেনি অথবা সেটাকে আমরা দেখার সামর্থ রাখিনি। তাই কাব্যের যে নিজস্ব দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা ছিল সেটা অধরাই থেকে গেছে।

বাঙালি মধ্যবিত্তের কবিতায় শব্দ, ধ্বনি, ছন্দ ও বাক্য দিয়ে আঙ্গিক নির্মাণ যত জরুরী, দার্শনিক ভাবনার প্রকাশ ততখানি জরুরী কি? আমরা আধুনিক কবিতার সাফল্য মাপি আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে পাঠকের মনে তৈরি প্রতিক্রিয়ার প্রাবল্যে। কবিতা ভাব, চিন্তা বা দার্শনিক প্রশ্নের মোকাবেলা করলো কিনা সেটা জরুরী নয়।

সব উপনিবেশেই সম্ভবত আধুনিক কবিতার আঙ্গিক নির্ভরতার এই সমস্যা হয়েছে। ইউরোপের কাব্য যে পর্যায় গুলো অতিক্রম করে সাবালক হয়েছে তার সাথে সাথেই বদলেছে তার আঙ্গিক। কিন্তু আমাদের সমাজ ও কাব্য সেই পর্যায় অতিক্রম করেনি। তাই আধুনিক বাংলা কাব্য গণ মানুষের হয়ে উঠতে পারেনি।

তাই এই প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত হবেনা যে, বাংলা কাব্যের আধুনিকতার এই অভিজ্ঞতা কি তার নিজের অভিজ্ঞতা? নাকি আধুনিকতার সাধনা করতে যেয়ে বাংলা কবিতা তার নিজের উৎসের সাথে নিজের দুঃখজনক বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে?

প্রখর বাঙালি দার্শনিক বিমল কৃষ্ণ মতিলাল ঠিক এই ধরনের প্রশ্নেই ক্লাসিক্যাল স্টাডিজের বরাতে বলেছেন,

ধ্রুপদী চর্চা বলতে আমি আবার শুধু অতীতের সাহিত্যপাঠ বোঝাচ্ছি না। দর্শন নীতিশাস্ত্র এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সেই সহজ সত্যটি মনে রাখতে হবে যে মানুষ ভুঁইফোড় নয়, তাঁর একটা নির্দিষ্ট অতীত, ইতিহাস প্রেক্ষাপট আছে। আমাদের মানস চিন্তাধারারও একটা প্রবাহ আছে এবং এসবই তো নেমে এসেছে প্রাচীন যুগ থেকে। এখন তাঁর সঙ্গেই যদি আমাদের কোন যোগ না থাকে আমরা তো মাটির তলি খুজে পাব না।

শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। বুঝতে পারব না কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এবং কিভাবে। আর আমরা যদি সচেতনভাবেই এই অজ্ঞাত অবস্থাকে মেনে নিই আমাদের পক্ষে বা চিন্তার ক্ষেত্রে আদৌ কোন সৃজনশীল কাজ করা সম্ভব? সম্ভব নয়, কারন সেক্ষেত্রে এই চিন্তা সৃষ্টির কোন ভিত্তিভূমি থাকবে না। জানেন, পুরোপুরি ধার করা বস্তু নিয়ে বেশী দূর এগোন সম্ভব নয়, বিশেষ কতকগুলি গাছের পরিচর্্যা বর্ধনের জন্য টব যথেষ্ট নয়, তাদের মাটিতেই রোপন করতে হবে। অতএব সৃজনমুখী চিন্তার স্রোত অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন অপরিহার্য।

পৃথিবীর সব আদি চিন্তা এসেছে কাব্যের রুপ ধরে। সকল ধর্ম চিন্তাকে ধারন করেছে কাব্যের রুপেই। কারণ চিন্তার কাব্যরূপ সাধারণ্যে সহজে গ্রহণীয়। ধর্ম তাঁর গভীর দার্শনিক চিন্তাকে কাব্যরূপ দিয়ে দিগ্বিজয় করেছে। কিন্তু আজকের কাব্যে চিন্তাই অনুপস্থিত সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

শব্দ আর বাক্য নির্মাণের গ্যারাকল থেকে বাংলা কবিতা মুক্তি পেয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা আর অস্তিত্বের মূল ধরে নাড়া দেয়ার দুঃসাহস দেখাক, তার সংযোগ ঘটুক আবহমান বাংলার কাব্যচর্চার সঙ্গে যা এখনো নিম্নবর্গের চৈতন্যে বহমান। কবিতার একজন নগণ্য পাঠক হিসেবে কবিদের কাছে এটাই আমার বিনীত প্রার্থনা।

(লেখাটি কবিকণ্ঠ কবিতা পত্রিকার মাঘফাল্গুন ১৪২২ সাল সংখ্যায় প্রকাশিত)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter